গ্রামের হাট প্লাসটিকে বেহাত
পারম্পরিক শিল্পীদের স্থান কমছে. গ্রামীণদের
জীবনযাত্রা পাল্টেছে. শহরে নতুন বাজার. বিক্রি খারাপ
নয়. নতুন প্রজন্মের সাড়া ভালই. এই বাজার
গ্রামীণ শিল্পীদের অচেনা. ঠকবার ভয়ও আছে. জনগণের পয়সায়
আয়োজিত শহুরে মেলাগুলো চলেযাচ্ছে ধণী কর্পোরেটিয় ফড়েদের কবলে. আইনি পথে খুচরো ব্যবসায় অবাধ বিদেশি পুঁজি ঢুকছে বাজারে. পরম্পরার পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে. পথব্যবসায়ী আর
গ্রামশিল্পীদের জোটেই ভারত-চিন-পারস্য বিশ্ব শিল্পের ৮০ শতাংশের অংশিদার ছিল. এই অক্ষের বড় অংশিদার ছিল বাঙলা. তাই দেশে
জ্ঞাণ বিজ্ঞাণ চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিল.
১৮৩৬এও বাঙলা-বিহারের একলাখ গ্রামে
ছিল দেড় লাখ পাঠশালা. সেই কেন্দ্রবিহীন গ্রামভিত্তিক পাঠশলা পরিচালন করছে
গ্রামগোষ্ঠী.
পলাশীর পর দেশী পড়াশুনো ধংস হয়েছে
ইওরোপিয় নতুন ধরণের হিসাবরাখার পড়াশুনোর তুমুল প্রচারে
শহুরে ভারত ভুলেগিয়েছে, পথ ব্যবসায়ীরা অকেন্দ্রিয়ভাবে শয়ে শয়ে বছর ধরে ভারতজুড়ে
বিশদে পণ্যের হিসেব রাখা, বীমা ব্যবস্থা, দ্রব্য বিতরণ ব্যবস্থা, দীর্ঘদিনধরে
দ্রব্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, পুঁজি বিনিয়োগের বিকেন্দ্রিয় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন. শুধু জটিল বললে ভুল হবে, ব্যাপ্তি আজও অকল্পনীয়ও. ইওরোপের ডবল
এন্ট্রি হিসেব আবিষ্কারের বহু আগেই ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পদ্ধতিতে কাজ করতেন.
অহিংসপথে জ্ঞাণবিপড়াশুনোর পথিকৃত ভারত, অতীতে
বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বিশ্বকে অবাধে জ্ঞাণ বিতরণ করেছে, পেটেন্ট করাকে ঘৃণা করেছে,
বিশ্বজোড়া একচেটিয়া আফিম, নীল, নুন আর সোরা উত্পাদন হত বাঙলায় তবুও বিশ্বধংসী
শিল্পবিপ্লব ঘটায় নি, কৃষকমারা নীলকরও হতে চায় নি.
এখনও ৯৯শতাংশ গ্রামশিল্পী বিদ্যুত ব্যবহার করেন না, আজও
ডোকরা কামারদের ধাতুর কাজে জং পড়ে না, একবিংশ শতকেও হাতের তাঁতের গুণমানের
আশেপাশে আসতে পারে না কলের কাপড়, ভারতের পারম্পরিক সেচ ব্যবস্থা আজও বিষ্ময়, এখনও
ভারতীয় স্থাপত্যবিদ্যার মূলে পৌঁছতে পারে নি পশ্চিম, ইওরোপ টিকা আবিষ্কারের আগে
টিকাদান আর শল্যচিকিত্সা সাধারণ কাজ ছিল, বিহার-বাঙলার দেড় লক্ষ গ্রামে এক লক্ষ
প্রাথমিক পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন চন্ডাল, মুচি, দোসাধ, মুসলমান-খ্রিস্টান শিক্ষক,
গ্রামীণদেরই অর্থে আর পরিকাঠামো ব্যবহার করে, এলাহাবাদেরমত গরম অক্ষাংশে বরফ তৈরি
হত. ভারতের চিকিত্সা ব্যবস্থা ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছে
বিষচিকিত্সার এলোপ্যাথি ব্যবস্থা, দস্তা পরিস্রবণে আজও পারম্পরিক ভারতীয় প্রযুক্তি
অনন্য, হাল্কা জাহাজ(ক্লিপার) তৈরির প্রযুক্তি ইংরেজরা নিয়েছিল বাঙলা আর বম্বে
থেকে, বাঙলার গ্রামসমাজের নানান ধরণের হালের নথি করে ইংলন্ডে কৃষি বিকাশ হয়েছে,
পশ্চিমকে গ্রীষ্মের উপযোগী সুতির কাপড় পরিয়েছে, খোলামেলা বাংলা(বাংলো আর কারি
শব্দটি বাঙালা থেকে চুরি করা) স্থাপত্যের বাড়ি তৈরি করতে শিখিয়েছে, মশলা খেতে
শিখিয়েছে. সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতায় ড্রাই ডক, কলণবিদ্যায় কেরলের
অবদান, শূণ্য, দশমিক, পাইএর মান, পৃথিবীর ব্যাসের মান তৈরিতে ভারতের অবদান বহু
আলোচিত. হরপ্রসাদ আর রাখালদাস প্রমাণ করেছেন বাঁকুড়ার পোখন্নার
গ্রামের কামারদের তৈরি অজর অমর লৌহস্তম্ভ আজও দিল্লিতে মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে.
এরকম বহু জ্ঞাণ চুরি করে ইওরোপ অধর্মণ থেকে উত্তমর্ণ
মহাদেশে পরিণত হয়েছে. আজও এই জ্ঞাণকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে. অথচ পশ্চিমি প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে নিয়ন্ত্রণ আর শ্রম প্রতিস্থাপনের জন্য. এশিয় প্রযুক্তি তার উল্টোপথে হেঁটে বিশ্বকে শিখিয়েছে একসঙ্গে বেঁচে থাকার
জীবনযাত্রা. সেই ইতিহাস ভুলেছেন বহু গ্রামশিল্পী. ভুলেছেন বাঙলা বিকাশে তাঁদের পুর্বজদের অবদান. সরকারি,
বেসরকারি সংস্থার অর্থে অনেকেই আজ বিদেশি নকলে ব্যস্ত. অনেকেই তাঁদের
বংশপরম্পরার কলাবিদ্যা ছাড়ছেন.
দেশি পড়াশুনোর অংশিদার ছিলেন গ্রামশিল্পীরা
বাঙলার গ্রামীণ শিল্পীরা ভুলে গিয়েছেন তাঁদের পূর্বপুরুষ
ছিলেন ভারত সভ্যতার স্রষ্টা. এঁরা অজন্তা ইলোরা, বরবুদর, দিল্লির লোহার মিনার, মসলিন
কাপড় তৈরি করতেন. এরাই ছিলেন বিশ্বযশা শিল্পী, প্রযুক্তিবিদ. এঁদের পণ্য, অভিনয়-বাদ্য কলা রপ্তানি হত বিশ্ব বাজারে. এঁদের কর্মকুশলতায় ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাঙলার অর্থনীতি
ছিল উদ্বৃত্ত. সারা বিশ্বের বণিকেরা বাঙলাতে আসতেন বাণিজ্য করতে. বাঙলার শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করারমত বিশ্বে খুব
কম শিল্পী ছিলেন.
বালুচরী, মসলিন, রেশম, তুলো, এন্ডি, মোম, মধু বাঁশ, কাঠ,
শিতলপাটি, গৌড়িগুড়মদ, পাথরশিল্প, শাঁখশিল্প, আখ, চিনি, নুন, সুপুরি, নীল, চাল,
লাক্ষা, আফিম, সোরা, পান, খয়ের, হাতি, হাতিরদাঁতশিল্প, শোলা, নৌপোত, চিত্রকলা, শিল্পকলাসহ
বহু দ্রব্যের চাহিদা ছিল অসীম.
এই সব পণ্য তৈরি আর চাষ করতেন এই শিল্পীরাই. ১৮০০ সাল
পর্যন্ত ইওরোপ, বাঙলা তথা ভারতের জীবনযাত্রা নকল করত. বাঙলাই
বিশ্বকে পথ দেখিযেছে. বাঙলা প্রযুক্তিও রপ্তানি করেছে. প্রযুক্তি ছিল
এই শিল্পীদের পূর্বজদের দখলে. এই দেশি
পড়াশুনোর অংশিদার ছিলেন গ্রামশিল্পীরা. পলাশির পর
পড়াশুনো পরিবেশ ধংসই হয় নি, তাঁদের রুটিরুজিতে হাত দিয়েছে রাষ্ট্র.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন