কলাবতী মুদ্রার বারোমাস্যা
মৃত্যুর ছায়া
পেরিয়ে বাঁচার নতুন পথে গ্রামশিল্প, শিল্পী
এই অত্যাশ্চর্য ধ্রুপদী লোকনাট্যরীতির জনপ্রিয়তা
লোকসমাজে শ্রেষ্ঠতম। আবার বলছি,
শ্রেষ্ঠতম। অবশ্য আরও লোক শিল্পেরমতই এর গায়েও মৃত্যুর ধূসর ছায়া
পড়েছে – মায়ামৃদঙ্গ,
সৈয়দ মুসতাফা সিরাজ
মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসে আলকাপ গান(গ্রামীণ ভারত সভ্যতায় সব অভিকর শিল্পই গান) আর কিশোরী
বেশী ছোকরা আর কুশীলবদের মরমীয়া মমতায় তুলে ধরেছিলেন সৈয়দ মুজতাফা সিরাজমশাই। নিজের অভিজ্ঞতায় সিরাজমশাই লিখেছিলেন আলকাপ শিল্পজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ধূসর
মৃত্যুর মনকেমন প্রতিবেদন। মুক্তবিশ্বে
সেই ছায়া আরও বড়, আরও গাঢ়, আরও গভীর হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হস্তশিল্প, তাঁত,
নাচ-গান-বাজনা-অভিনয়ে।
মেদিনীপুর-নদিয়া-জলপাইগুড়ি-দিনাজপুর-কোচবিহার-দার্জিলিং-মুর্শিদাবাদ-হুগলির
সুতি-রেশম-এন্ডি-মুগার তাঁত, মনসা-চন্ডীর শোলার মেল্লি আর ফুলের আচার, কালিকাচ
নাচ, ডাং-সুতো-বেণী-ছায়া পুতুল নাচ, বন্ধুয়ালা গান, সং, বহুরূপী, লেটো, গাজন,
মুখা খেইল নাচ, ডোমনি, মাছানি, খন, বোলান, বনবিবির পালা, চেরচুর্ণি, দেতরা, নাচনি,
হাজারো ব্রতকথা-আচার-আচরণ, সত্যপীর পালা, বিষহরা পালা, পীর-পীরানি, মদনকাম নৃ্ত্য,
বৈরাতি নাচ, ধেমাল নাচ, শিকনি ঢাল নাচ, ছো, রায়বেঁশে, নটুয়া, পাইক, ভাওয়াইয়া-চটকা,
চা বাগানের গান, তিস্তাবুড়ির গান, তুখ্যা গান, সাধুগান, ধুয়া(ঢুয়া) গান,
মনসা-চণ্ডী-ধর্ম-শীতলাসহ অন্য মঙ্গলগান, মনসার ঝাঁপান, বিষহরা, সত্পীর নাটক, জারি,
সারি, মুর্শিয়া, ফকিরি, তেহট্টের মালপাহাড়িদের নাচ, নানান মুখোশ নাচ আর গান, পট,
গাজির গান, ময়নামতির গান, গোপীচন্দ্রের গান, কবিগান, আখড়াই, হাফআখড়াই,
জেলেপাড়ার গান, ধানভানার গান, চৌকো-চওড়া-চক্ষুদানপট গান, গাজিপট গান, পীরের গান,
ফকিরি গান, মুর্শিদ্যা, পালাগান, লীলা গান, রামায়ণ গান, ঝুমুর, টুসু, ভাদু,
সাঁওতালি, মুণ্ডারি, হো, লোধা নাচ-গান, রাভা নাচ, মেচ নাটক, মালপাহাড়ি নাচ,
রাজবংশী সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙলার আরও হাজারও গ্রামীণ কৃষ্টি, হস্ত আর বয়নশিল্পে
লেগেছে আলকাপের ধূসর মৃত্যুর ছোঁয়া।
গ্রামীণ শিল্পীদের জীবনে বায়না আর বরাত না পাওয়া,
প্লাসটিক আর বিদেশি পণ্যে হাট-বাজার দখল হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বেদনা, হাহাকার। শিল্প-শিল্পী-জীবনে ফুটে উঠছে নিজের কাজ থেকে নীরবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার
আশংকা। চাহিদাসংস্কৃতির চাপের বাইরে থাকা গ্রামীণ সংস্কৃতির
নাভিশ্বাস। প্রায়উদাসীন প্রচারমাধ্যম। গ্রামীণ
কৃষ্টি অশ্লীল, মোটাদাগের এবং লৌকিক, গ্রামের মানুষ অশিক্ষিত, দরিদ্র, নিরক্ষর,
গ্রামের প্রযুক্তি পিছিয়ে পড়া, অনাধুনিক, প্রাচীণ - এই ইওরেপিয় দর্শণ ছড়িয়ে
পড়ছে সরকারি নীতি, রাজনীতি আর গবেষণায়। বাঁহাতে
ছুঁড়ে দেওয়া চাকরি বাঁচানো প্রকল্প, সর্বরোগহর বিদেশি প্রযুক্তির প্রয়োগের
একবগ্গা সিদ্ধান্তে গ্রামশিল্পসমাজে নাভিশ্বাস।
লৌকিক সংস্কৃতি মধ্যবিত্তের ভোট বাঁচানো, পিঠচাপড়ানির কুমিরছানা। অশংকার কথা, আজও সফলভাবে বেঁচে থাকা বহু গ্রামশিল্প, শুধুই সম্মানের অভাবে
নতুন প্রজন্ম বাপদাদার শিল্পে আসতে চাইচ্ছে না।
ঐতিহ্যময়
গ্রামশিল্প কেটেছেঁটে শহুরে বাজারে বিক্রি করতে দিল্লিতে একটি আস্ত মন্ত্রক বরাদ্দ
হয়েছে। সেই সরকারি প্রকল্পে বর্জ্য অশিল্প তৈরি হচ্ছে। গ্রামকে মেনস্ট্রিমের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যোগ্য করে তুলতে বহু
প্রকল্পে প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে। কাজের কাজ খুব
একটা কিছু হচ্ছে কীনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে গ্রামীণদের অংশগ্রহণ খুব কম।
স্বাধীণতার পর
ভারতে শুরু হয়েছিল টেকনলজি ট্রান্সফার প্রকল্প। আজও চলছে। ইওরোপ-আমেরিকা-জাপান প্রযুক্তির ঋণ নিয়ে দাঁড়াল রাজনেতা, আমলা, ব্যবসায়ী,
স্বেচ্ছাব্রতীদের সামনে। এতে তিনটে পাখি মরল।
এক, পশ্চিমি প্রযুক্তি সর্বশক্তিমান, আধুনিক এবং
সর্বরোগহর, এই দর্শণ গাঁয়ে পৌঁছে দেওয়া গেল।
দুই, যতটুকু দেশিয় প্রযুক্তি টিকে ছিল, তাকে প্রাচীণ,
গ্রামীণ, পারম্পরিক, প্রিমিটিভ দেগে, উচ্ছেদ করে সসম্মানে জাদুঘরে সাজানোর
প্রকল্প জুটল। শহুরেদের জন্য গ্রাম মারার নতুন চাকরি তৈরি হল। তিন, পশ্চিমি যন্ত্রপাতির বাজার শহর ছাড়িয়ে গ্রামে তৈরি হল। যেমন শাঁখের করাত। অত্যন্ত
প্রাচীণ যন্ত্রটি প্রায় কাজ হারিয়েছে। এসেছে
বিদ্যুতে চলা কাটাই যন্ত্র। বহু ছোট
শাঁখারি উচ্ছেদ হচ্ছেন। ড্রিল মেশিনে সূক্ষ্ম কাজ অসম্ভব। নষ্ট হচ্ছে
বাজার। বিদেশি বাতিল যন্ত্রে দেশি প্রযুক্তির সর্বনাশ। কারু, বস্ত্র শিল্পে উচ্ছেদ হচ্ছেন লাখো বংশপরম্পরার শিল্পী। বাঙলায় স্বরস্বতী-হরপ্পার স্মৃতির গালার পুতুল, দিনাজপুরের শোলার মুখোশ,
বীরভূমে সেরপাই, অথবা বাঁকুড়ায় দশাবতার তাস তৈরির কাজ এসে ঠেকেছে শুধু বৃন্দাবন
চন্দ, মধুমঙ্গল মালাকার, শম্ভু, আর শীতল ফৌজদারদের পরিবারে।
এই প্রবণতা
বাড়ছে। এঁরা নাছোড়বান্দা, কিন্তু কতদিন পেটের সঙ্গে সমঝোতা
করে বাঙলার শিল্প বাঁচানোর দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরবেন! শিল্প ছেড়ে ১০০ দিনের
নিশ্চিন্ত কাজে পেট চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে বাঙলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কয়েকটি
অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। তবুও বাঙলা-বাঙালির হেলদোল নেই। দক্ষিণ বাঙলায়
পারম্পরিক শিল্পের অবস্থা দিন দিন অবনতি ঘটছে। তুলনায়
উত্তরবঙ্গ পরম্পরা, ঐতিহ্যের অনেক কাছাকাছি।
কিন্তু এ
কাঁদুনি আর কতদিন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন