(দ্বিতীয়াংশ)
প্রায়শ্চিত্তের
বার্তা
১৭৫৭র মাত্র
শদুএক বছর আগের কথা. শ্রীঅদ্বৈতমহাপ্রভু ভারত জুড়ে খোঁজ করছিলেন যুগপুরুষের. যিনি নাড়িয়ে দেবেন শহুরে বাঙলা.
বিপ্লবীসত্ত্বার খোঁজ পেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যে. শ্রীচৈতন্যের
ডাকে হাজার উচ্চমধ্যবিত্ত পথে নেমেছিল. এরপর বাঙলার
বাচিক ইতিহাস চৈতন্যময়. ১৭৫৭র চক্রান্ত শেষে, বাঙলায় সামরিক শাসন. উচ্চ-মধ্যবিত্তের সিন্দুকে ধণাগম হচ্ছে. শাসক ইংরেজ,
বাঙালি মধ্যবিত্তকে লুঠের ভাগিদার করেছে. দুশ বছর
গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সামনা সামনি রক্তহোলি খেলেছে. সেই দাগ আজও
লেগে রয়েছে আমাদের অনেকেরই দেহে. কলাবতী মুদ্রার যে দল এই জ্ঞাণভাণ্ডার নথিকরণের কাজটি
করতে বসেছে, তাদের গায়েতো বটেই.
কলাবতী মুদ্রা মধ্যবিত্ত
সমাজের হয়ে, গ্রামভারতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেচলেছি তত্ব-তথ্যের মুটে-মজুরি
তর্পণের মধ্যে. অপূরণীয় ক্ষত গ্রামীণদের দেহে, মনে. সেই প্রচেষ্টার একজন নীরব দলরূপে নিজেদের উত্সর্গ করেছি. প্রতি পলে চেষ্টা করছি পূর্বজদের কৃতকর্মের দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে
নিজেদের যোগ্য করে তোলার. প্রায় ২০ বছর গ্রামে থাকার সুবাদে বলতে পারি বাঙলার
গ্রামগুলিতে নজর ফেলে দেখলে অনুভব করা যাবে, আড়াইশ বছরের ক্ষতচিহ্ন. সেখান থেকে চুঁইছে অপমানবোধের ঘাম, রক্ত, বেদনা. আঘাতে আঘাতে
গ্রামীণ শিল্পীসমাজ আজ মূহ্যমান.
তাঁদের আবার
পুরোনো পথে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন গ্রামীণদের ভাষ্য, দর্শণের নথিকরণ.
শিক্ষা,
অর্থনীতি, প্রযুক্তি আর সংস্কৃতিতে বাঙলা দুশ বছর আগেও উত্তমর্ণ ছিল. স্বাধীণ বাঙলায় নেই নেই দশা.
গ্রামশিল্পীদের নতুন প্রজন্মে ভাঁটার টান. শুধু আর্থিক
দৈন্য নয়. গরীবিয়ানার প্রচারতো ছিলই. সঙ্গে
শিরদাঁড়া বেঁকানোর প্রকল্পের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে ১৭৫৭র পরে. মার্ক্সবাদীদের অবদান খুব কম নয়.
মার্ক্স-এঙ্গেলসএর নিদানে তাঁরা বিশ্বাস করেন শিল্পোন্নত ইওরোপই বাঙলার
ত্রাতা. তাই দেশি প্রযুক্তিকে আদিমতম, লৌকিক ইত্যাদি ধারণায়
দেগে দেওয়া হল. দেশি প্রযুক্তি রাষ্ট্রের বাইরে উপড়ে পড়ল. বাঙলার বিকশিত পারম্পরিক প্রযুক্তির বলিদান সম্পন্ন হল ১৯৪৭এর পর. শুধু বেঁচেরইল সহানুভূতির রাজনীতি.
চাই গ্রামীণ
দৃষ্টিতে নথিকরণ
বাঙলার গ্রামের
জ্ঞাণবিজ্ঞাণ চর্চা নথিকরণ প্রয়োজন গ্রামীণদের অহং জাগিয়ে তুলতে. আজকের গ্রামীণদের অনেকরই অতীত স্মৃতি ঝাপসা. তাঁদের
পূর্বপুরুষ বিশ্বে তৈরি করেছিলেন নতুন দার্শণিক পথ, নতুন বাজার. এই নিভেযাওয়া আলো জ্বালাতে চাই কয়েক হাজার বছরের জীবনধারা, দর্শণ এবং
প্রযুক্তির নথিকরণ প্রচার. শিল্পবিপ্লবে
উদ্ধত পশ্চিম নিজেদের বোনা জালে জড়িয়ে বিশ্বকে ধ্বংস করছে. পশ্চিমি
প্রযুক্তি লাভের কড়ি সিন্দুকেকে ভরা, মানুষকে উচ্ছেদ, মানুষের মন দখল আর প্রকৃতি
লুঠে ব্যবহার হয়েছে. এই প্রযুক্তিতে মানুষ উদ্বৃত্ত. একে নিয়ে
শিল্পবিপ্লবোত্তর পশ্চিম এগোতে পারছে না. নড়বড়ে
অর্থনীতি, নতুন প্রযুক্তির দিশাহীনতা থেকেই পরিস্কার. বিশ্বকে হাজার
হাজার বছর ধরে রক্ষা করা গ্রামীণ প্রযুক্তির প্রয়োগের সময় আসছে. অন্য পথ নেই. তখন প্রয়োজন হবে এই নথিকরণের তথ্যগুলি.
এই দল গ্রামে
গ্রামে জ্ঞাণ নথিকরণের কাজ করেছে দু দশক ধরে. দেখেছে গ্রামে
অত্যাচারের আঘাতগুলো দেখা যাচ্ছে. বহু ব্যক্তি,
সংঘ নানান নথি করে চলেছেন. সেই সাড়ার
মধ্যেই কলাবতী মুদ্রার দল খুঁজতে চেয়েছে গ্রামীণ পথ. নানান
পথবন্ধুর লেখা, সাহিত্য, বর্ণনা, নথিকরণের কাজে দেখতে চাইছে বাস্তব অবস্থা. পূর্বপথিকদের একটি হাতেগোণা অংশ গ্রামীণদের অনুভব নানানভাবে তুলে ধরেছেন. দলটি, নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করল ভারত আর বাঙলার সমাজকে. বলা দরকার পূর্বজদের বহু কাজে ছড়িয়ে রয়েছে ঔপনিবেশিক দর্শণের রেশ. তাঁদের অনেকে আজও প্রণম্য. আজও প্রশ্ন
ওঠেনি তাঁদের দর্শণের. নতুন প্রশ্ন তুলে গ্রামসমাজের দর্শণের শিক্ষায়,
গ্রামীণদের হাত ধরে শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্তের পিঠচাপড়ানি দর্শণএর বাইরে বেরিয়ে আসাও
জরুরি. মাথা নিচু করে শিক্ষার্থীর প্রশ্নমুখ চোখে নিজেদের
নিবেদন করার কাজ শুরু করল এই দল. অনেকেই এই
দর্শণকে মধুর-দাস্যভাবরূপে কটাক্ষ করেছেন. তাঁদের
কটাক্ষে এই দল কৃতার্থ. হয়ত সঠিক পথে চলতে পারছে তারা.
গ্রামশিল্পীরা
আজ বাঙলার সংস্কৃতি জগতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন. মূল মঞ্চ দখল করে রেখেছেন
শহরে বাস করা ক্ষমতার নানান অঙ্ক সমাধান করা শহুরেরা. এঁরাই
বিশ্ববাসীকে ফোকের মায়াজালে ডুবিয়ে রেখেছেন. আর মাঝে মধ্যে কলকাতার প্রসেনিয়াম
নাট্যচর্চায় উদ্বাস্তরমত চলে আসে লৌকিক নাট্যচর্চা.
যখনই
প্রসেনিয়ামের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখনই মনেপড়ে দেশি নাট্যচর্চাকে. পার পেয়েগেলে
সেই ত্রাতা ইওরোপ. যে নাট্যচর্চা জগত লেবেদফের নাটক করার প্রচেষ্টাকে বাঙলা
নাট্যজগতের শুরু বলে ভাবেন, অন্ততঃ তাঁদের কাছে বাঙলার গ্রামীণ সংস্কৃতি জগতের
কিছু পাওয়ার নেই এ কথা বুকঠুকে বলে দিচ্ছে কলাবতী মুদ্রা.
ঠিক এই বাস্তব অবস্থায়
দাঁড়িয়ে কলাবতী মুদ্রা দুটি গ্রামশিল্পীদের সংগঠণকে প্রত্যক্ষ্যভাবে সাহায্য করতে
বদ্ধ পরিকর. বাঙলার প্রণম্য গ্রামীণ শিল্পীরা তৈরি করতে যাচ্ছেন বাঙলার প্রথম গ্রামশিল্পীদের দ্বারা পরিচালিত দুটি সংগঠণ. যে শিল্পীরা ক্রাফ্টমার্কেরমত প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদ হওয়ার আশংকায় ভুগছেন,
যারা আজ বাঙলার সংস্কৃতি জগতে ব্রাত্য, তাদের আজ একজোট হওয়ার সময় এসেছে.
একজোট না হলে
যে শক্তিগুলো সংস্কৃতি অঙ্গণে ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে, তারা এতদিন একা ছিল. আজ খোলা
বাজার নীতিতে তাদের সঙ্গে জুটেছে কর্পোরেট বড় ব্যবসায়ীরা. তাই নবতম উদ্যমে
গ্রামশিল্পীদের ভালকরার নামে আদতে উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছে কর্পোরেট এনজিওরা.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন