(চতুর্থ অংশ)
পারম্পরিক জ্ঞাণ
নথিকরণ উদ্যম
সংগঠণ উদ্যম -
বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ এবং বঙ্গীয় পারম্পরিক অভিকর শিল্পী সংঘ
পুজোয় দুটি মন্ডপ, প্রদর্শণী
আর দোকানে শিল্পকর্ম রাখার পর আবারো নতুন করে কলাবতী মুদ্রার সঙ্গে বাঙলার
শিল্পীদের সংযোগ বাড়তে শুরু করে. বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শোলা শিল্পী দিনাজপুরের
মধুমঙ্গল মালাকার বাঙলার শিল্পীদের একজোট করার আহ্বান জানান.
এই কাজে দুটি দিন মধুমঙ্গল
মালাকার এবং শিল্পী বন্ধু বিশ্বজিত চক্রবর্তী কলাবতী মুদ্রার সদস্যদের সঙ্গে একটি
দীর্ঘ আলোচনা আয়োজন করেন, যেখানে বাঙলার গ্রামীণ শিল্পীদের নানান সুবিধে অসুবিধে
নানান বিষয় আলোচনা হয়. এই আলোচনায় মধুমঙ্গল কলাবতী মুদ্রাকে এই দায়িত্ব গ্রহণের
জন্য আহ্বান জানান. কলাবতী মুদ্রার পক্ষ থেকে বিনীতভাবে মধুমঙ্গলকে বলা হয়, দুটি
কারনে কলাবতী মুদ্রা এই দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম, প্রথমতঃ কলাবতী মুদ্রার সংবিধানে
এই সুযোগ রাখা হয় নি. যদিওবা সে করতে পারে, সে খুব সীমিতভাবে করতে উত্সুক. আর
নৈতিকভাবে কলাবতী মুদ্রা ব্যাপক এই কাজ করতে চায় না. তার কাজ জ্ঞাণ নথিকরণ. সংগঠণ
নয়.
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে
লৌকিক বাঙলার জন্য কাজ করা শহুরে সংগঠণগুলি সুদূর অতীত থেকেই তাদের সুবিধেমত গ্রাম
বাঙলার শিল্পীদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে. এতে সংগঠণ অথবা কয়েকজন শহরমুখী শিল্পীর
কাজের সুযোগ বাড়লেও সামগ্রিকভাবে বাঙলার শিল্পীদের বিন্দুমাত্র উপকার হয় নি.
সংগঠণের প্রধাণ, সদস্যরা সরকার থেকে
সামাজিক কাজ করার নামে বহু সুযোগ, অর্থ, সম্মান পেয়েছেন, বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বিনা
বাধায়, কিন্তু বেচার গ্রামশিল্পী যে তিমিরেই ছিলেন, সেই তিমিরে আজও পড় রয়েছেন. এই
দুটি কারনের জন্য সরাসরি কলাবতী মুদ্রার পক্ষে শিল্পীদের নিয়ে সংগঠণ করা সম্ভব নয়.
প্রয়োজনে সে শিল্পীদের নানান উদ্যমকে সাহায্য করতে পারে.
এই আলোচনা সভায় কলাবতী
মুদ্রার পক্ষ বলা হয় যে বাঙলায় আদতে পারম্পরিক লৌকিক আর আদিবাসী শিল্পীদের সংগঠণের
অস্তিত্ব নেই. গ্রাম শিল্পীদের নামে যে সব সংগঠণ চলে তার অধিকাংশই গ্রাম শিল্পীদের
জন্য কাজ করার সংগঠণ. সেখানে গ্রামশিল্পীদের ইচ্ছা অনিচ্ছা গৌণ, শহরের কিছু
মানুষের ভাবনা-চিন্তাই প্রাধাণ্য পায়. সেই জন্যই বিভিন্ন গ্রামশিল্পীদের নিয়ে কাজ
করার সংগঠণের অভাব নেই. অভাব শিল্পীদের কাজ করার সংগঠণ, যেখানে শিল্পীদের ইচ্ছে অনিচ্ছে
প্রাধান্য পাবে.
কলাবতী মুদ্রা যেহেতু বহুদিন
ধরেই গ্রামবাঙলার শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করছে, সেহেতু এ ধরণের সংগঠণ গড়ে তুলতে
শিল্পীদের বহুদিন ধরে উত্সাহ দিয়ে আসছে. গ্রাম শিল্পীরা যদি এ ধরণের সংগঠণ
গড়ে তোলেন, তাহলে কলাবতী মুদ্রা তার
সমস্ত উদ্যম সংহত করে, তার সমস্ত অভিজ্ঞতা জড়ো করে শিল্পীদের,সংগঠণকে সদর্থক করতে
তুলতে সাহায্য করবে. কর্মশালায় তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা
বর্ণনা করেন মধুমঙ্গল মালাকার. তিনি এ বিষয়ে কলাবতী মুদ্রাকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ
করেন.
এই কর্মশালায় কলাবতী মুদ্রা
বিনীতভাবে মধুমঙ্গল মালাকারকে জানায় শিল্পীদের দ্বারা, শিল্পীদের পরিচালিত যে কোনও
সংগঠণকে সমর্থণ করতে কোনও বাধা নেই. এধরণের কোনও উদ্যম নৈতিকভাবে কলাবতী মুদ্রা
পক্ষে গ্রহণ করা অসম্ভব যেহেতু, এই ধরণের গণ সংগঠণ তৈরি করতে সে অনিচ্ছুক.
আবারও কলাবতী মুদ্রার পক্ষ
থেকে আন্তর্জাতি খ্যাতি সম্পন্ন শোলা শিল্পী দিনাজপুরের মধুমঙ্গল মালাকারকে এ
বিষয়ে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করা হয়. বলা হয় তিনি যদি এই সংগঠণের দায়িত্ব নিতে পারেন
তাহলে কলবতী মুদ্রা তার সমস্ত যোগাযোগ উদ্যম এর পেছনে ব্যয় করবে.
মধুমঙ্গল নৈতিকভাবে রাজি হয়েও
আরও কিছুটা সময় চান. তিনি বলেন, তাঁকে তাঁর পুরোনো সাথীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে.
তাঁদের মতামত তার অত্যন্ত প্রয়োজন. এই কর্মশালায় ঠিক হয়, তিনি একমাস সময় নিচ্ছেন.
এই একমাস বাদে আবার তিনি কলাবতী মুদ্রার সঙ্গে একত্র হবেন. বৈঠকে যোগদান করার জন্য
শিল্পী মধুমঙ্গল এবং তাঁর সাথীদের ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিনেরমত সেই বৈঠকটি ইতি টানা
হয়.
ঠিক একমাস বাদে নতুন করে আবার
আলোচনা শুরু হয়. মধুমঙ্গল জানান তিনি শিল্পীদের দুর্দশায় ব্যথিত. তিনি নিজে একটি
চাদোকান করে সংসার ব্যয় নির্বাহ করেন. অথচ তাঁর বিদেশে যতটুকু যোগাযোগ, প্রায় ১২
বার তিনি বিদেশ গিয়েছেন, সবই শোলাশিল্পী হিসেবে. তিনি আগামী দুবছর ধরে নতুন সংগঠণ
গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর. তার জন্য শারীরিক পরিশ্রম তিনি দেবেন. কিন্তু কলাবতী
মুদ্রাকে অন্য সমস্ত কাজগুলি, যেমন আইনি ঝঞ্ঝাট, লেখালিখি ইত্যাদি করতে হবে. তবেই
তিনি এগোবেন.
মধুমঙ্গলের প্রস্তাব
সর্বান্তকরণো সমর্থন জানানো হয়. কলাবতী মুদ্রা পক্ষ থেকে মধুমঙ্গলকে অছি সদস্য
হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়. মধুমঙ্গলকে জানানো হয়, বিধান বিশ্বাস এবং ইন্দ্রনীল
ভট্টাচার্য অছিপরিষদে পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন. সেখানে তাঁকে এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ
নিবেদিতা দাস রায়কে নিয়ে আসার কথা ভাবছে কলাবতী মুদ্রা. সেই বৈঠকেই মধুমঙ্গল
মালাকার তাঁর সম্মতি দেন. তাকে জানানো হয়
আগামী বছরে তাঁকে কলাবতী মুদ্রায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে. এবং সেই সময়ই অন্য দুটি
সংগঠণ নথিভুক্ত করা হবে.
তিনি জানান এই দুটি সংগঠণ
তৈরি করতে কলাবতী মুদ্রা বিশদে পরিকল্পনা করুক. সেই পরিকল্পনায় তিনি তাঁর মতামত
দেবেন. এবং তার পরেই দল গড়ে উঠতে যা যা করণীয় সব পরিকল্পনা হবে যৌথভাবে.
বিশ্বেন্দু নন্দ সবার সঙ্গে কথা বলে সরকারি আইন মোতাবেক নথি করণের কাগজপত্র তৈরি
করে এবং দুটি সংগঠণ তৈরির পরিকল্পনা হয়.
নথিকরণের আগে সেই বার্তা
জেলায় জেলায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন মধুমঙ্গল. উদ্দেশ্যে শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় এবং
এই প্রস্তাব জানানো. যৌথভাবে একটি উত্তরবঙ্গ পরিভ্রমণের পরিকল্পনা করা হয়.
মধুমঙ্গল মালাকার, বিশ্বজিত চক্রবর্তী এবং কলাবতী মুদ্রা পক্ষে বিশ্বেন্দু নন্দ এই
উদ্দেশ্য বেশ কয়েকবার সমগ্র উত্তরবঙ্গসহ নানান জেলা পরিভ্রমণ করেন.
প্রাথমিকভাবে হাতেগোণা শিল্পী
এই উদ্দেশ্য বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন. বলেন
তাঁদের এবাবদে অভিজ্ঞতা বেশ খারাপ. সংস্থা আগে তৈরি হোক তার পর তাঁরা ভেবে দেখবেন
সংস্থার কাজে যোগ দেবেন কী না. বলা দরকার এই কথা বলা অধিকাংশ মানুষই কিন্তু পরের
দিকে সংগঠণের নানান কাজে অতি আগ্রহে অংশগ্রহণ করেন. তবে বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত
শিল্পী কিন্তু সরাসরি এই সংগঠণে যোগ দিতে অস্বীকার করেন. কেননা তাঁরা কলকাতাভিত্তিক
অন্য সংগঠণের সঙ্গে যুক্ত.
তবে বিভিন্ন জেলার নানান
কারিগর, নানান বস্ত্র শিল্পী, নানান অভিকর শিল্পী এই সংগঠণ গড়ে ওঠার আগেই
সর্বান্তকরণে এই উদ্যমে সাড়া দিয়ে পাশে
এসে দাঁড়ান এবং নানান ভাবেক এই সংগঠণের সুস্থিরতা কামনা করেন. সংগঠক মধুমঙ্গলের
পরামর্শে আন্তর্জাতিক শিল্পী শিল্পগুরু নেপাল সূত্রধরও এই সংগঠণে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা
প্রকাশ করেন.
পশ্চিমবঙ্গ পরিভ্রমণের পর
আবার একটি বড় বৈঠক আহ্বান করা হয়. সেই বৈঠকে দুটি সংগঠণের নাম ঠিক হয়. ঠিক হয়
একটির নাম হবে বঙ্গীয় পারম্পরিক
কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ এবং অন্যটি বঙ্গীয় পারম্পরিক অভিকর শিল্পী সংঘ. অছি পরিষদ গঠণ হয়. ঠিক হয় দুটি সংগঠণেরই শীর্ষে অবস্থান করবেন দুই
আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা শিল্পী যৌথভাবে মধুমঙ্গল মালাকার এবং নেপাল সূত্রধর.
এছাড়াও বেশ কয়েকজন শিল্পীবন্ধু ও শিল্পী এই সংগঠণে যোগদান করেন.
ঠিক হয় পঞ্জীকরণ হবে ২০১১র
জুন মাসে. সেই উদ্দেশ্যে আরও কএকবার সংগঠণের নানান বিষয় আলোচনা করতে বৈঠক হবে ঠিক
হয়. এও ঠিক হয়, সংগঠণের প্রাথমিক দপ্তর হবে কলাবতী মুদ্রার দপ্তরে. উত্তরবঙ্গের
দপ্তর হবে মধুমঙ্গল মালাকারের বাড়ি, মুস্কিপুর, বড়গ্রামে.
পুজো শেষ করেই ডলিজএ
প্রদর্শণী এবং দুটি দোকানে পণ্য পৌছেঁদেওয়া এবং তার পরেই নতুন দুটি সংগঠণের উদ্যোগ
নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করতেই বছরের বাকি সময় অতিবাহিত হয়ে যায়. কলাবতী মুদ্রার পক্ষ থেকে
আমরা কৃতজ্ঞ মধুমঙ্গল মালাকারের মত শিল্পী সংগঠণের কাজে নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছেন.
কলাবতী মুদ্রা তাঁকে তাঁর সংগঠণ যাত্রায় সব ধরণের সাহায্য করবে.
কলাবতী মুদ্রার পক্ষ থেকে
তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে কাজ করা বিশ্বেন্দু নন্দকে এই সংগঠণ গড়ে তুলতে তাঁকে
সাহায্য করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে. আগামী বাঙলার গ্রামীণ শিল্পীরা বছরে নতুন করে
এই সংগঠণ গড়ে তুলতে চলেছেন, তাঁদের কাজে কলাবতী মুদ্রা যদি সহায়কের কাজ করতে
পারেন তাহলে তাঁদের জীবনে তাঁরা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এমন দাবি তাঁরা
করতেই পারেন.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন