মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

কলাবতী মুদ্রার বারমাস্যা ২০১০-২০১১, Annual Report of Kalaboti Mudra 2010-2011


(শেষাংশ)
নথিকরণের কাজ
যেহেতু কলাবতী মুদ্রা র অন্যতম সদস্য হতে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শোলাশিল্পী গুরু মধুমঙ্গল মালাকার, সেহেতু তাঁরই অনুরোধক্রমে সংস্থা তার জেলায়(দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর) নথিকরণের কাজ করেছে. বেশ কয়েকদিন এই জেলায় কাটিয়ে কলাবতী মুদ্রার নথিকরণ দল এইসবগুলি বিশদে নথি করে. এই দলের অনেকেই যেহেতু ছোটবেলা থেকেই শহুরে পশ্চিমি পড়াশোনায় বেড়ে উঠেছি. পড়ার বইতে লেখা নানান ভুল ধারণা মাথায় ঢুকে রয়েছে আজও, তাকে অনেকটা কাটাতে পেরেছি.
এর আগে জেনেছি শহুরে নান্দনিকতাকে বলে বলে ১০০ গোল দিতে পারে লৌকিক অথবা আদিবাসী সংস্কৃতি এবং এ নিয়ে আজ আর খুব বেশি বিতর্কের যায়গা নেই, যদিনা আলোচক নিজে শহুরে চশমা পরে গ্রাম সংস্কৃতিকে হারাতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকেন. অন্যদিকে লৌকিক অথবা আদিবাসী প্রযুক্তি যে শিল্পবিপ্লবজাত প্রযুক্তিকে পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে জড়িয়েথেকে গাঠনিক জটিলতায় অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে, তার উদাহরণ আমরা পেয়েছি এই নথি করণ থেকে. এর জন্য আমরা, কলাবতী মুদ্রার সকলে মধুমঙ্গল মালাকারের কাছে কৃতজ্ঞ.
কৃতজ্ঞ এই কারনে যে তিনি আমাদের নতুন এক বিশ্ব, নতুন সংস্কৃতির সন্ধান দিয়েছেন. যদিও এর আগে আমরা এক বছরে এর থেকে বেশি নথিকরণের কাজ করেছি. কিন্তু তাঁর হাত ধরার পরই আমরা একটি সাংস্কৃতিক এলাকায় এতসব জটিল প্রযুক্তির ধারণা পেয়েছি, জটিল সংস্কৃতির রূপরেখার উদাহরণ পেয়েছি.
বিশেষ করে চদর বদর. আমাদের ধারণা ছিল, বাঙলায় আর চদরবদরের অস্তিত্ব নেই. যা রয়েছে সবই দুমকায়. শান্তিনিকেতনে যে চদরবদরটিকে দেখানো হয়েছে, সেটি কিন্তু দপমকা থেকে আনা. সংগ্রাহক, রবিকান্ত চতুর্বেদী এই তথ্য জানিয়েছেন. একমাত্র মধুমঙ্গল মালাকারই এই তথ্য যোগান দিয়েছেন আমাদের.
চদরবদর
বাঙলায় প্রায় মৃত এই সুপ্রাচীণ অথচ এক্কেবারে আলোচনা না হওয়া নতুন ধরণের সাঁতালি পুতুল নাচ চদর বদর. বাঙলার সাঁওতাল সমাজ এই পুতুল নৃত্যটি ভুলে গিয়েছে. একমাত্র দিনাজপুরের ডমন মুর্মু এই সংস্কৃতিটি আজও ধরে রয়েছেন.
পশ্চিমি প্রভাবে আমরা আজ বিশ্বাস করে করে নিয়েছি, আদিবাসী সংস্কৃতি এবং আদিবাসী প্রযুক্তি নাকী সব খুবই সরল ও সোজা. কিন্তু চদরবদর সব্বাইকে ভুল প্রমাণ করবে. আদতে ইওরোপ ভারত তথা ভারতের সংস্কৃতিকে ওপর ওপর থেকে দেখে যা প্রমাণ করার চেষ্টা কদরেছে, স্বাধীণতার আগে থেকেই আমরা মধ্যবিত্তরা সেই তালে তাল দেওয়ার চেষ্টা করছি. বিশেষ করে বিদ্যাসাগর, রামমোহন সর্বোপরি মেকলে প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠায় ভারত সম্বন্ধে শহুরে ভারতীয়দের সম্বন্ধে খুবই ভুল ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে, বিশেষ করে গ্রামবাঙলা সম্বন্ধে. তাই ছোটবেলা থেকেই শহুরে ভারতীয়রা এমন এক ধারণা গড়ে ওঠে যার সঙ্গে ভারতীয় জীবনধারণের বাস্তবতার কোনও মিল নেই.
এই চদরবদরের বিশদ বিবরণ এবং কর্মশালার অভিজ্ঞতা আমরা বিশদে বলেছি লোকফোক ব্লগে. শুধু একটি কথা আমরা বলতে চাই, ভারতের আদিবাসী এবং লোক সমাজ নিয়ে যে ধারণার প্রচার বড় শিল্পনির্ভর সভ্যতা বিগত ৩০০ বছর ধরে করে এসেছে তার অধিকাংশ আসূয়াভিত্তিক এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ. নিজের অক্ষমতা এবং অযোগ্যতায় ঘোমটা পরাতে শহুরে সমাজতত্ব আর নৃতত্বের বিকাশ ঘটেছে.
গমীরা নাচ
দিনাজপুরের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গী গমীরা মুখোশ নাচ. বহু গ্রামসংস্কৃতি কর্মীও গমীরা আর গম্ভীরার মধ্যে পার্থক্যটি আজও গুলিয়ে ফেলেন. গম্ভীরা মূলতঃ মালদা এলাকার. শিবের অপর নাম গম্ভীর. এবং যে কোনও সামাজিক ক্রিয়া কর্মের মধ্যে অসঙ্গতি দর্শণে শিবকে সাক্ষী খাড়া করে তাকে অভিযোগ জানানো হয়, শিব হে অথবা নানা হে ডাক দিয়ে.
অন্যদিকে পাশের জেলা দিনাজপুরে গমীরা অন্যতম প্রধাণ সংস্কৃতি. বিষয়বস্তু অথবা প্রকাশভঙ্গীতে এই দুই প্রতিবেশী জেলার দুই অভিকর শিল্পে বিন্দুমাত্র সাজুজ্য নেই. দুটি দুই রকম. দুটি দু ধরণের প্রতকাশভঙ্গীর. গমীরা যেমন শিবকে নানারূপে সম্বোধন করে থাকে, অন্যদিকে গমীরা আরাধণা করে  দেবী দুর্গার. দুর্গাকে আরাধণা করে সে. দুর্গার রীপ বর্ণনাই তার মুখ্য কাজ. অসুর দলনী, দশপ্রহরণ ধারিনীকে সে পুজন করে.
গমীরা নাচের অন্যতম উপকরণ মুখোশ. এই মুখোশ দিনাজপুরের দুই জেলার নানান আচারে ব্যবহৃত হয়. এই মুখেশ পরেই নানান শিল্পী নানান চরিত্রের রূপ ধারণ করেন. এ প্রসঙ্গে বলা যাক, এই নাটকে বলা ভাল নাচে শারীরিক সক্ষমতা এক বড় ভূমিকা পালন করে. এক চরিত্রের যখন ভর হয় তখন তার নানান কসরত দর্শকদের মোহিক করে দেয়.
আমরা যেন মনেরাখি এই সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গীটিতে রাজবংশী সমাজের মানুষই অংশগ্রহণ করেন. এই সমাজের দেশি পলিয়া, এই দুই গোষ্ঠীই এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে থাকেন. সাধারণতঃ শীতকালেই এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে.
এবং এর থেকেও কলাবতী মুদ্রার দলের কাছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে এই নথিকরণের কাজে. এই প্রায় প্রথাভাঙা জটিল নৃত্য-নাট্য ভঙ্গীমা থেকে শহরের সংস্কৃতিকে অনেক কিছু নেওয়ার আছে সে কথা নতুনভাবে এই নথিকরণের কাজ অন্ততঃ আমাদের  কলাবতী মুদ্রা সদস্যদের খুব জোরের সঙ্গে আরও একবার মনে করিয়ে দিল.
নথিকরণের পর আমরা জানলাম, শোলাশাল্পী মধুমঙ্গল মালাকারমশাই যাঁর হাত ধরে কলাবতী মুদ্রা এই নথিকরণের কাজটি করতে দিনাজপুর গিয়েছিল, নিজে সেই সংস্কৃতির এক বড় অংশ. এক সময় নিজে রাজবংশী সংস্কৃতির খন এবং গম্ভীরা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেছেন, একথা আমরা শুনলাম দলের কুশীলবদের মুখে.
এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যে ছবিগুলো দেওয়া গেল, সেগুলি কলকাতারসায়েন্স সিটিতে আন্তর্জাতিক লোক উত্সবে দলটির অনুষ্ঠান. দল প্রধান বদ্রীনাথ বসাকের নেতৃত্বে এই দলটি নথিকরণের কাজে অংশগ্রহণ করেন, তেমনি এই দলটিও সায়েন্স সিটির অনুষ্ঠানে সফলভাবে অংশগ্রহণ করেন. এই অনুষ্ঠানে যেসব শিল্পী অংশগ্রহণ করেন তাদের নাম এখানে উল্লেখ করা হল-
১. মনেরঞ্জন সরকার, ২. কাঞ্চন সরকার, ৩. কৈলাস সরকার, ৪. সোমেন সরকার, ৬. ভদরু সরকার, ৭. মলিন সরকার, ৮. পবিত্র সরকার, ৯. কলেন সরকার, ১০. শ্যামা সরকার, ১১. বদ্রীনাথ বসাক
জনরা
জনরা আদতে আদিবাসী রাজবংশী গয়না এ তথ্য কলাবতী মুদ্রা বেশ কয়েক দশক আগে থেকে জানত. কিন্তু মটরু দেবশর্মার খোঁজ পাওয়া গেল মধুমঙ্গল মালাকারের যোগ্যতায়. অনুবিধে হল, এই কর্মশালা আয়োজন করতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন. কেননা জনরা মূলতঃ রূপোর গয়না.
প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের সাক্ষীতে জানা যাচ্ছে অন্ততঃ তিন-চাক দশক আগেও রাজবংশী সমাজে জনরার ভূমিকা ছিল অতীব সাধারণী. খুব সাধারণ ঘরের মহিলারা জনরা পরে ঘুরতেন. আজও কলাবতী মুদ্রা দিনাজপুর জেলার অনেকটা গ্রামের ভেতর দিকে, বিশেষ করে খুনিয়াডাঙি, কুশমন্ডি, বালুরঘাট, দুর্গাপুর, বড়গ্রাম, ঊষাহরণ এই সব এলাকায় যায় সেখানে অনেক পুরোনো পরিবারের মহিলারা আজও জনরা পরেন.
যখন আমরা মধুমঙ্গল মালাকারের সুযোগ্য উপস্থাপনায় জনরার কর্মশালার আয়োজন করি, তখনও জানিনা যে এই কর্মশালা পরিচালনা করতে রূপো নিদেনপক্ষে পিতল অথবা অন্য ধাতু পাওয়া বেশ কঠিন কাজ. ফলে এই বছর আমরা এই কর্মশালা আয়োজন না করতে পারলেও আগামী বছরগুলোতে সময় বের করতে পারলে এই কর্মশালা আয়োজন করতে পারি এমন এক প্রতিশ্রুতি আমরা নিজেদের দিয়েছি.
প্রশিক্ষণ শিবির
শীতলপাটি
কোচবিহারের ঘুঘুমারিতে প্রদীপ দের বাড়িতে কলাবতী মুদ্রা তাঁরই অনুরোধে একটি শীতলপাটি থেকে নানান ব্যবহার্য দ্রব্য প্রস্তুত কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজন করে. শিবির পরিচালনা করেন এনআইএফডির স্নাতক সুদেবী কর.
এ ছাড়াও রাভা তাঁত আর বুনন, দিনাজপুর মুখোশ, নক্সালবাড়ির কাঠের কাজ, খন নাটক ইত্যাদি বিষয়ে সমীক্ষা ও কয়েকটি এলাকায় কর্মশালা আয়োজন হয়.
প্রতিবন্ধী সচেতনতা কর্মশালা
কলাবতী মুদ্রার উদ্যোগে দুই দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী সৌরভ বসু এবং সমীর ঘোষাল বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের নানান বিষয় নিয়ে বিশদ কর্মশালা আয়োজন করে. নদিয়ার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে তারা এই কাজগুলি করে. এ নিয়ে বিশদ বিবরণ কলাবতী মুদ্রার ব্লগে পাওয়া যাবে.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন