মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

কলাবতী মুদ্রার বারমাস্যা ২০১১-২০১২, Annual Report of Kalaboti Mudra 2011-2012

(পঞ্চসাংশ)
গুরুকুল
কলাবতী মুদ্রার গুরুকুল শুধু  সম্পদ সংগ্রহের কাজ করে না, এটি তার নাচের দলে নিয়মিত সদস্য সরবরাহেরও কাজ করে থাকে. বিগত বছর থেকে কলাবতী মুদ্রা সরাসরি চন্ডীগড়ের প্রাচীণ কলা কেন্দ্র থেকে তার পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে. এবং প্রাচীণ কলাকেন্দ্র সরাসরি কলাবতী মুদ্রাকে তাদের একটি পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে. এমনকী গুরুকুলের শিষ্য নয় এমন বহু শিক্ষার্থীও পরীক্ষার্থী হিসেবে কলাবতী মুদ্রায় পরীক্ষা দিচ্ছে.
এবছরও কলাবতী মুদ্রা থেকে ৪০ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়. ১০ জন পরীক্ষা দেয় নি বয়সের কারনে. তাছাড়াও অনেকেই এখোনো উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে নি.
এই সংস্থায় সপ্তাহে তিনদিন চলে এই গুরুকুল, দক্ষিণ শহরতলীর বড়িশার নাবালিয়া পাড়ার জাগৃহী ক্লাবে.
এ ছাড়াও গড়িয়ায়ও অন্য একটি বিদ্যালয় চলে.
নৃত্যদল
প্রতিবছরেরমতই এবছরও কলাবতী মুদ্রার নাচের দল সারা ভারতে অনুষ্ঠানে করেছে.
বাল্টিমোরের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এবছর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাক্তণ ছাত্রী হিসেবে কলাবতী মুদ্রার প্রধান ড. ললিতা ঘোষ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে অনুষ্ঠিত বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে যোগদান করেন. তিনি সেখানে ১৫ দিন থাকেন. এবং এউ অনুষ্ঠানে ললিতা ঘোষ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে রবীন্দ্র নাথের কচ-দেবযানী নৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন.
গঙ্গা ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ ক্রুইজ
এছাড়াও এবছর থেকে কলাবতী মুদ্রা আরও একটি বড় সুযোগ পেয়েছে নিজের সংস্কৃতি বিদেশিদের সামনে প্রদর্শণ করার.  গঙ্গা ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ ক্রুইজএ কলাবতী মুদ্রা ভারতের সংস্কৃতি প্রদর্শণের জন্য ডাক পেয়েছে. এই বিলাসবহুল জাহাজটি কলকাতা থেকে বারানসী পর্যন্ত যায়, বিভিন্ন এলাকা দর্শণ করিয়ে. বেশ  কয়েকটি রাতে ভারত তথা বাঙলার নানান গ্রামীণ  নৃত্য দেখিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে সে.
এবছর যেসব যায়গার নেচেছে সংস্থার দল অথবা দল প্রধান
বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন, বাল্টিমোর, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
বালিযাত্রা উত্সব, কটক
সম্বলপুর বৌদ্ধ মহা উত্সব
নর্থ ইস্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন, নিপকো প্রতিষ্ঠা দিবস, পূর্বাঞ্চল শাখা, কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি, শিশিরমঞ্চ
রায়দিঘী জগধাত্রী পুজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান
রায়দিঘী সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়
দুর্গোতসব ২০১১, নয়াদিল্লি
মথুরা তৈলশোধনাগার
বসন্তকুঞ্জ
আর কে পুরম
লোদি কমপ্লেক্স
বাসন্তী উত্সব, চাউলখোলা, পূর্ব মেদিনীপুর
গঙ্গা ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ ক্রুইজ
কালনা
ব্যান্ডেল
টেগোর ফাউন্ডেশন, বেহালা ব্লাইন্ড স্কুল
সুন্দরবন লোক সংস্কৃতি উত্সব, জয়গোপালপুর গ্রামবিকাশ কেন্দ্র, বাসন্তী
শিশির মঞ্চঃ সত্রিয়া নৃত্যের ইতিহাস ও উপস্থাপনা
বাঙলার একমাত্র সত্রিয়া গবেষক এরং নৃত্যাঙ্গণা, ড.ললিতা ঘোষকে সত্রিয়া নৃত্য উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি. সেই অনুষ্ঠানে কলাবতী মুদ্রা প্রধান ড. ললিতা ঘোষ সত্রিয়া নৃত্যের ইতিহাস এবং পরে নত্রিয়া নৃত্যের নানান ব্যকরণ এবং শেষে দশাবতার নৃত্যটি উপস্থাপনা করেন.

হন্যমানের ২০ বছরঃ লেখক  জয়া মিত্রর মুখোমুখি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঙলা সাহিত্য হন্যমান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে রয়েছে. পুরস্কার তো পেয়েইছে, সবথেকে বড় পুরস্কার হন্যমান পেয়েছে পাঠকের কাছ থেকে - উপন্যাসটির প্রতি অসামান্য আনুগত্য প্রদর্শণ করেছেন বাঙলার সাহিত্যপ্রেমীরা. ২০ বছর পেরিয়ে গিয়েও হন্যমান  আজও উজ্জ্বল এবং একই রকমভাবে সময়ের প্রতিনিধি.
সেই উপলক্ষ্যে কলাবতী মুদ্রার আয়োজনে যাদবপুরের ইন্দুমতী সভাগৃহে লেখক জয়া মিত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়. শমীক এই আলোচনাসভায় হন্যমান, সেই সময়, লেখকের মানসিকতা এবং তার প্রেক্ষিত নিয়ে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা জয়া মিত্রের সঙ্গে আলোচনা করলেন.
এই আলোচনায় শোলাকৃতি উপহার দেওয়া হয় লেখক ও আলোচকদের. আলোচনাসভাটি গ্রন্থনা করেন সাংবাদিক চন্দ্রশেখর  ভট্টাচার্য.
অযাচক
বিগত বছর থেকেই দুটি দৃষ্টিহীন তরুণের সঙ্গে কলাবতী মুদ্রা তার সীমিত সামর্থে কাজ করে চলেছে.  সম্প্রতি তারা কলকাতার এক প্রায়-প্রতিষ্ঠিত নাট্য দল থেকে বিরিয়ে এসে কলাবতী মুদ্রার কাছে  নতুন করে সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ চায়. তারা তাদের ভাবনা নিয়ে বলাবতী মুদ্রাকে বলে যে তারা অপ্রতবন্ধী পিতামাত্রা প্রতিবন্ধী শিশু আর প্রতিবন্ধী বাবা-মায়ের অপ্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের নিয়ে নৃত্য-নাট্য দল খুলতে চায়. এবং তারা চায় কলাবতী মুদ্রা তাদের এই বিষয়ে সাহায্য করুক.
কলাবতী মুদ্রা তাদের আরও ভালকরে ভেবে আসতে বলে এবং জানায় তারা নতুন একটি সংগঠণ রচনা কররুক. কলাবতী মুদ্রা তাদের এবাবদে সমস্ত সাহায্য দেবে. বিগত সংগঠণদুটিরমত তারাও এবাবদে কলাবতী মুদ্রার সাহায্য চায় এবং নাম ঠিক করে দিওয়ার জন্য ও অনুরোধ করে. কলাবতী মুদ্রা তাদের জানায় এ কাজটি তারা করতে পারবে আগামী বছরেই. এবং এ বিষয়ে তারা সম্মতি জানায়.,

কলাবতী মুদ্রার বারমাস্যা ২০১১-২০১২, Annual Report of Kalaboti Mudra 2011-2012

(চতুর্থাংশ)
অন্যান্য কাজ
এবছর কলাবতী মুদ্রা খুব বেশি কাজ করতে পারে নি. তার একটা বড় সময় আর সম্পদ এই দুই সংগঠণের ভিত্তি মজবুত করতে ব্যায় হয়েছে. ফলে যতটুকু কাজ করার দরকারছিল, ততটা কাজ সে করতে পারে নি.
তবে কয়েকটি সমীক্ষা করেছে, খাগড়ার শোলার কাজ, তাহেরপুরের সরা, দিনাজপুরের কালিকাচ, মুস্কিপুর গ্রামের কার্তিক পুজো আর উত্তরবঙ্গের আলপনা. এর বিশদ বিবরণ রয়েছে লোকফোক ব্লগটিতে. কলাবতী মুদ্রা আবারও বলছে, তার দৃষ্টিতে দুটি সংগঠণের এবছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সংগঠণ গড়ে ওঠা জরুরি. তার জন্য সব কিছু করতে সে উদ্যমী. তাই এবছর তার মূল কাজ, নথি করণের কাজ সে প্রায় বন্ধ করেছে, শুধু সংগঠণের স্বার্থে.
ব্লগ
সংস্থার বড়তম রোজগারটা আসে buybengalihandicrafts.blogspot.com ব্লগ থেকে, অন্যভাবে বললে বাহলার বেশ কিছু গ্রামশিল্পীর পণ্যশিল্প দ্রব্য বিক্তি করতে পারে এই ব্লগের মাধ্যমে. এই রোজগার থেকেই দুটি সংস্থার সাংগঠনিক ব্যয় আর কলাবতী মুদ্রারও নানান ব্যয় সঙ্কুলান করতে হয়. এবছরে একটি বড় অর্ডার আসে মুম্বইএর পুজো কমিটি থেকে. তারা ব্লগ সূত্রে সংস্থার কাছে জানতে চায় যে মুম্বইএর একটি পুজো কমিটি তারা ছোএর (ছৌ নয়) মুখোশ দিয়ে সাজাতে চায়. সেই মুখোশ তারা সংস্থার কাছ থেকেই কিনবে. সেই পরিমান একলাখ টাকারও বেশি.
ইমেল আর ফোনেই সমস্ত কাজ সারা হয়. বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের অন্যতম প্রধান নেপাল সূ্ত্রধরকে এই মুখোশ জোগাড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়. মুম্বইএর এই সংস্থাটি কলাবতী মুদ্রাকে বেশ কিছু অর্থ আগ্রিম করে. পুজোর ঠিক আগে কলাবতী মুদ্রার কনসালট্যান্ট বিশ্বজিত চক্রবর্তী নিজে ভারতীয় রেলে জিনিসটি বুক করে সেই সংস্থায় মুখোশগুসি পৌঁছে দেন এবং বাকি অর্থ নিজে নিয়ে আসেন.
এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পারা যাচ্ছে না. কলাবতী মুদ্রা শিল্পীদের শিল্প দ্রব্য বিক্রি করে দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ নিজের খরচের জন্য রেখে দিয়ে লাভের অধিকাংশ অর্থই শিল্পীকে দিয়ে দেয়. একটি অভিযোগ ওঠে মধ্যসত্বভোগী সম্বন্ধে, যে তারা বাজারের নিয়ম জানে, ক্রেতার মনোভাব জানে তাই তারা অনেক বেশি দামে সেই শিল্পদ্রব্যগুলো বিক্রি করতে পারে. এবং এই  লভ্যাংশের অধিকাংশ অর্থ আর শিল্পীদের কাছে ফিরে আসে না. সেটি মধ্যসত্ত্বভোগীরই পকেটস্থ হয়.
কলাবতী মুদ্রা এই অভিযোগ সম্বন্ধে সচেতন. এই অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রে সত্যও হতে পারে. এ ধরণের ছোটছোট বহু সামগ্রী বছরভর বিক্রি করে কলাবতী মুদ্রা. কিন্তু কলাবতী মুদ্রা শিল্পীকে জানায় সে কী দামে জিনিস বিক্রি করছে এবং কত লাভ করছে এবং সে শিল্পীকে লভ্যাংশের কত ফেরত দিচ্ছে. 
দোকান
দুটো দোকানেই কলাবতী মুদ্রার পণ্য বিক্রি হচ্ছে. তবে ব্লগটির মত নয়. ধীরে ধীরে এই জিনসগুলি বিক্রি হচ্ছে. বিক্রির পরিমান খুব একটা আশাপ্রদ নয়.
এই দুটি দোকান চালাতে কলাবতী মুদ্রার অনেকটা হাত বাঁধা. নির্ভর করতে হয় দোকানের বিক্রির পরিকাঠামো আর মালিকের ইচ্ছের ওপর. ডলিজএর অসুবিধে হল, ডলিও নিজে শিল্পদ্রব্য বিক্রি করে. তাই কলাবতী মুদ্রার সরাসরি বিক্রির পরিকাঠামো না থাকায় অনেকসময় ডলির ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে বিক্রি. কলাবতী মুদ্রা অভিজ্ঞতা হল, ডলি সাধারণতঃ নিজের কেনা দ্রব্য বিক্রি করতে উ্তসাহী, ডলির যে দুটি মেয়ে জিনিস দেখায় তাদেরও গ্রাম শিল্প সম্বন্ধে ধারণা কম. গত বছরের দোকানে প্রদর্শণীর অভিজ্ঞতার দেখা গিয়েছে সংস্থার কর্মীরা বিক্রির সময় থাকেন বলেই দ্রব্যগুলোর নানান তত্য ক্রেতাদের দিতে পারেন. এবং সেগুলো অনেক বেশি বিক্রি হয়. এই কাজটি ডলির দোকানে হচ্ছে না. যা বিক্রি হচ্ছে, তাও নাম মাত্র.
বিনীতার আর্থ কেয়ারেও প্রায় একই সমস্যা. বিনীতার বই বিক্রি উদ্দেশ্য. বইএর যায়গায় শিল্পদ্রব্য বিক্রি তার কাম্য নয়. কিন্তু এই দ্রব্যগুলো সাজিয়ে রাখলেও ক্রেতার কাছে দোকানের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে. ফলে তার পক্ষে এখুনিই সেই শিল্পদ্রব্যগলো সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় আবার সেগুলো বহাল তবিয়তে থাকুক সেটাও চাইছে না সে.
যাইহোক এবছরও এই দোকানগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না কলাবতী মুদ্রা. তবে পরের বছর নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে তার সম্পদ সংগ্রহের নানান দিক.
বিশেষ করে এই দোকানগুলি পরোক্ষে আর ব্লগটি প্রত্যক্ষভাবে চালাবার অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় সে বুঝতে পারছে, তার পরিকল্পনা ঠিক. কিন্তু সম্পদ আর পরিচালনায় কিছুটা খামতি থেকে গিয়েছে. নিয়মিতভাবে এই দোকানগুলি দেখাশোনা করার কাজে শ্রমশক্তি নিয়োগ করতে হবে, তবেই গ্রামশিল্পীদের শিল্পকর্মের বিক্রি বাড়তে বাধ্য. যেমন ঘটছে ব্লগে.
নতুন দোকানের ভাবনা
ফলে আগামী দিনে সম্ভব হলে সে নিজে কয়েকটি দোকান চালাবার পরিকল্পনা করছে, যে দোকান শুধু গ্রাম শিল্পের প্রচার আর প্রসারের  কাজ করবে না. এটি তিনটি বড় কাজ করবে -
১. গ্রাম অর্থনীতির অন্য সবল দিক, এবং গ্রাম শিল্পের অঙ্গাঙ্গী বন্ধু প্রাকৃতিক চাষের পণ্য বিক্রির সাহায্য করবে. গ্রামের কৃষকেরা এমনকী শিল্পীরাও রাসায়নিক সারে চাষ করতে বাধ্য হন. কেনা পরিবেশ বন্ধু এই কৃষি পণ্য বিক্রি করার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই. সেই কাজ করবে এই বিপণী
২. বাঙলাজোড়া শিল্পীদের গ্রামগুলি আজও ভ্রমণের উপযুক্ত বলে গণ্য হয় না. সেই গ্রামগুলোতে ভ্রমণের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলে সেগুলি এই দোকান মার্ফত বিক্রি করার ব্যবস্থা হবে.
৩. অভিকর শিল্পীদেরও বাজার ধরার চেষ্টা হবে এই দোকান থেকে.
এই লক্ষ্য রেখে বাঙলা জোড়া দোকান করার পরিকল্পনা  তৈরি করে রেখেখে কলাবতী মুদ্রা এই দুই তৃণমূলস্তরের সংগঠণকে সঙ্গে নিয়ে. দোকানের নাম হবে পরম. এই নামটি নেওয়া হয়েছ পরম্পরা শব্দটি থেকে. এছাড়াও অসীম বোঝাতে অতীতের ভারতীয়রা পরম শব্দটি ব্যবহার করতেন.
হাটের পরিকল্পনা - হাট বসেছে শুক্রবারে
আগামী দিনে বাঙলার হস্ত, বস্ত্র ও অভিকর শিল্পকে আরও অনেক পথ এগিয়ে নিয়ে যেতে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে সাপ্তাহিক হাটের ভাবনা শুরু করেছে কলাবতী মুদ্রা. এ নিয়ে সে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন মহলে প্রাথমিকভাবে কথাবার্তা চালাচ্ছে. আশাকরা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এই পরিকল্পনাটি রূপায়িত করতে পারবে সে.  আলোচনা খুবই আশাপ্রদভাবে হচ্ছে. কলকাতা পৌর সংস্থার বিভিন্ন উচ্চপদস্থ জনপ্রতিনিধিরা তার এই ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং পরিকল্পনা রূপায়ণ করত বিশদ প্রকল্প সমীক্ষা তৈরি করতে কলাবতী মুদ্রাকে জানিয়েছে.
কলাবতী মুদ্রা ঠিক করেছে এই হাটটির নাম হবে হাট বসেছে শুক্রবারে. এমনকী হাটটি শুক্রবারে না বসলেও এই নামে কলকাতা তথা বাঙলার নানান প্রান্তে এই হাটটি চলবে. এমনও হতে পারে হাটটি সারা সপ্তাহই বসছে.

পাড়ায় পাড়ায় হস্তশিল্প মেলা
এবছর করা গেল না. কলাবতী মুদ্রা আগামী বছর আশাকরছে এই প্রকল্পটি শুরু করতে পারবে. হাভলার হস্ত শিল্পকে পাড়ায় পাড়ায় নিয়ে চলে যাওয়া. ক্লাব অথবা বহুতল বাড়ির সমবেত কেন্দ্রে সপ্তাহের শেষ তিনদিন এই হাটটি বসতে পারে. এর সঙ্গে থাকবে দু একটা গান বাজনা এমনকী নাট্যানুষ্ঠানও.

কলাবতী মুদ্রার বারমাস্যা ২০১১-২০১২, Annual Report of Kalaboti Mudra 2011-2012

(তৃতীয়াংশ)
তাই প্রয়োজন এক জোট হওয়া
বিগত বছরের সমীক্ষায় কলাবতী মুদ্রা উদ্যম নিয়েছিল, মধুমঙ্গল মালাকারের নেতৃত্বে কলাবতী মুদ্রার সহায়তায় গ্রাম শিল্পীদের নিয়ে সংগঠণ গড়ে তুলতে. মধুমঙ্গল মালাকার নৈতিকভাবে রাজি ছিলেন এই কাজটি নিজের চওড়া কাঁধে তুলে নিতে. কিন্তু কলাবতী মুদ্রাকে নানান দপ্তরি কাজে তাঁকে সাহায্য করতে হবে. এই ছিল তাঁর শর্ত.  কলাবতী মুদ্রা আঁর শর্তে বিলকুল রাজি হয়ে যায়.
নতুন বছরের এপ্রিল মাসের এক বৈঠক বসে. অংশগ্রহণ করেন দিনাজপুরের মধুমঙ্গল মালাকার, পুরুলিয়ার নেপাল সূত্রধর,  দার্জিলিংএর ভবানী বিশ্বাস, কলকাতার বিশ্বজিত চক্রবর্তী এবং কলাবতী মুদ্রার পক্ষে ড. ললিতা ঘোষ, চন্দন চক্রবর্তী এবং বিশ্বেন্দু নন্দ. গত বছরের প্রস্তাবমত ঠিক হয়, দুটি সংস্থা গড়ে উঠবে. একটির নাম হবে বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ এবং বঙ্গীয় পারম্পরিক অভিকর শিল্পী সংঘ. সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হয়, এই সংঘ দুটির সদস্যপদে ৭০ শতাংশ গ্রামশিল্পীকে থাকতেই হবে. বাকি সংখ্যা শিল্পী বন্ধুরা হতে পারেন. মূলতঃ এই সংরক্ষণের ব্যবস্থার প্রস্তাব করে কলাবতী মুদ্রা. বৈঠকে উপস্থিত সমস্ত সদস্য এতে রাজে হন. বিগত বছরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই বৈঠকেই দুটি সংগঠণের নাম, তাদের কাজের উদ্দেশ্য এবং সংবিধানের খসড়া পেশ করেন বিশ্বেন্দু নন্দ. কয়েকটি পরিবর্তন এবং নতুন কয়েকটি ভাবনা আর  বিষয় যোগ করার ভাবনা ভাবা হয়. সেই ভাবনাগুলিও মেনে নেন উপস্থিত সদস্যরা. এবং ঠিক হয় এই  পরিবরিতনগুলি নিয়ে আগামী মাস থেকে সংস্থা দুটি নথিকরণের কাজটি শুরু করে দেবে কলাবতী মুদ্রা.
ঠিক হয় জুন মাসে বড়িষা এডিএসএআর দপ্তরে সংস্থা দুটির নথি করণ আর কলাবতী মুদ্রার সংস্কার হবে. প্রস্তাব আসে আগামী তিন বছর এই দুই সংস্থা মূলতঃ উত্তরবঙ্গের ছটি জেলা মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করবে. সম্ভব হলে, উপযুক্ত কর্মী পাওয়া গেলে অন্য জেলাগুলোতে সংগঠণ তার কর্মউদ্যোগও বাড়ানোর কাজ করবে. কিন্তু এই ছটি জেলায় সংগঠণ বিস্তার আপাততঃ সংগঠণের প্রাথমিক কাজ.
নানান সরকারি-বেসরকারি-সাংগঠণিক বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে জুন মাসে এই সংগঠণটি সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়. সে সময় কলকাতায় সংগঠণগুলির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন. নতুন করে ঠিক হয় মধুমঙ্গল মালাকার এবং নেপাল সূত্রধর এই দুই সংগঠণের প্রধাণের পদে থাকবেন. এবং অন্যান্যরা অছ্মন্ডলীরূপে কাজ করবেন.  এই দুই সংগঠণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কলাবতী মুদ্রার পক্ষ থেকে থাকলেন মধুমঙ্গল মালাকার, চন্দন চক্রবর্তী এবং ড. ললিতা ঘোষ এবং কর্মাধ্যক্ষ বিশ্বেন্দু নন্দ. মনে রাখতে হবে বিশ্বেন্দু নন্দ শুধুই কলাবতী মুদ্রার কর্মী, তিনি কলাবতী মুদ্রার সদস্য, কিন্তু অছি সদস্য নন.
ঠিক হয়, নথিকরণের পর কলাবতী মুদ্রার পক্ষে এই সংগঠণ দুটির সাংগঠণিক কর্ম দেখবেন মধুমঙ্গল মালাকার এবং তাঁকে সব কাজে সহায়তা করবেন বিশ্বেন্দু নন্দ.  
সংগঠণটি নথিভুক্ত হওয়ার পর আবার একবার উত্তরবাঙলা ভ্রমণের পরিকল্পনা হয়. নথি করণের সময় কলাবতী মুদ্রারও অছি পরিষদ সংস্কৃত করা হয়, মধুমঙ্গল মালাকার এবং কৃষি বিষেষজ্ঞ নিবেদিতা দাস রায় কলাবতী মুদ্রার অছিতে প্রবেশ করেন.  
দুটি সংস্থা সরকারি খাতায় নথিকরণের পরের মাসে আবার নতুন করে সমগ্র উত্তরবঙ্গের জেলায় নানান গ্রাম, নানান শিল্পীর সঙ্গে বৈঠক করেন নতুন সংগঠণের অছিবৃন্দ. সমস্ত ঘোরার সমীক্ষা, তাঁদের বক্তব্য এবং আরও কী করা যায় সে বিষয় নিয়ে আগস্ট মাসে নতুন করে বৈঠকে বসেন দুই সংগঠণের কর্মীবৃন্দ. সংগঠণদুটির আগামীদিনের কী কাজ সেই বিষয়ে বেশকিছু ভাবনা ও পরিকল্পনাতৈরি হয়. দক্ষিণবঙ্গের প্রতিনিধি এবং কলাগুরু নেপাল সূত্রধর বলেন শুধু উত্তরবঙ্গের ওপর জোর দিলে সংগঠণ দাঁড়াবে না. তাঁরই বক্তব্যের সূত্র ধরে দক্ষিণবঙ্গে নতুন করে কয়েকটি জেলায় সংগঠণের শাখা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়. নানান বিতর্কের মধ্যে এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়. ছিক হয় উত্তরবঙ্গেরমতই দক্ষিণবঙ্গেও এই অছি পরিষদ নতুন করে ভ্রমণ করবে এবং শিল্পীদের সংগঠিত করবে.
তিনদফা ভ্রমণের পর শিল্পীদের পরামর্শ, তাদের প্রস্তাব এবং নানান ভাবনা একত্রিত করে প্রাথমিকভাবে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিদের নাম ঠিক হয়-
কোচবিহারে প্রবীণ বাঁশ ও কাঠ শিল্পী গৌরাঙ্গ বর্মণ,
জলপাই গুড়িতে যৌথভাবে রাভা সমাজের মাথা গনট রাভা এবং মেচ সমাজের প্রধান দারেন্দ্র ঈশ্বরারী,
দার্জিলিংএর কাঠ শিল্পী ভবানী বিশ্বাস,
দক্ষিণ দিনাজপুরের খন শিল্পী গণেশ রবিদাস,
উত্তর দিনাজপুরের সংগঠক পরেশ সরকার
আর মালদহে বাঁশ শিল্পী মনোরঞ্জন বিশ্বাস
প্রত্যেক শিল্পীই নিজেরমতকরে তাঁর এলাকায় সংগঠণ বাড়াবার কাজ করবেন. মাঝে মাঝে দুটি সংগঠণের অছি পরিষদ সেই সব এলাকা ভ্রমণ করবেন, যদি প্রয়োজন হয়. তবে জেলা সংগঠণ স্বাধীণভাবে তাঁদের কাজ করবেন এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে জেলা প্রতিনিধিদের. শুধু সদস্যপদই নয় বিভিন্ন তথ্য দিতে হবে জেলা প্রতিনিধিদের. ঠিক একবছর পর জেলা প্রতিনিধিদের কাজকর্ম খতিয়েদেখার পর জেলা সংগঠণ তৈরি হবে. এর পরও অছি পরিষদের সদস্যরা এবং কলাবতী মুদ্রার পক্ষ থেকে যৌথভাবে জেলায় বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণ করা হয়. আগামী দিনে সংগঠণের কাজকর্ম বিষয়ে বিশদে আলোচনা করে কাজকর্মের দিশা ঠিক করার ব্যবস্থাও হয়.
তবে প্রাথমিকভাবে দলের সংগঠণকে মজবুত করে তুলতে আলোচনার সভার ওপর জোর দেওয়া হয়. ইতিমধ্যে সংঘের এক প্রতিনিধি ড. ললিতা ঘোষ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রতনিধিরূপে বালটিমোরের বঙ্গ সংস্কৃতি উত্সবে অংশগ্রহণ করতে যান. ঠিক তার পরই মধুমঙ্গল মালাকার ইংলন্ডে আন্তর্জতিক পাখি মেলায় অংশগ্রহণ করেন.

কলাবতী মুদ্রার বারমাস্যা ২০১১-২০১২, Annual Report of Kalaboti Mudra 2011-2012

(দ্বিতীয়াংশ)
প্রায়শ্চিত্তের বার্তা
১৭৫৭র মাত্র শদুএক বছর আগের কথা. শ্রীঅদ্বৈতমহাপ্রভু ভারত জুড়ে খোঁজ করছিলেন যুগপুরুষের. যিনি নাড়িয়ে দেবেন শহুরে বাঙলা. বিপ্লবীসত্ত্বার খোঁজ পেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যে. শ্রীচৈতন্যের ডাকে হাজার উচ্চমধ্যবিত্ত পথে নেমেছিল. এরপর বাঙলার বাচিক ইতিহাস চৈতন্যময়. ১৭৫৭র চক্রান্ত শেষে, বাঙলায় সামরিক শাসন. উচ্চ-মধ্যবিত্তের সিন্দুকে ধণাগম হচ্ছে. শাসক ইংরেজ, বাঙালি মধ্যবিত্তকে লুঠের ভাগিদার করেছে. দুশ বছর গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সামনা সামনি রক্তহোলি খেলেছে. সেই দাগ আজও লেগে রয়েছে আমাদের অনেকেরই দেহে. কলাবতী মুদ্রার যে দল এই জ্ঞাণভাণ্ডার নথিকরণের কাজটি করতে বসেছে, তাদের গায়েতো বটেই.
কলাবতী মুদ্রা মধ্যবিত্ত সমাজের হয়ে, গ্রামভারতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেচলেছি তত্ব-তথ্যের মুটে-মজুরি তর্পণের মধ্যে. অপূরণীয় ক্ষত গ্রামীণদের দেহে, মনে. সেই প্রচেষ্টার একজন নীরব দলরূপে নিজেদের উত্সর্গ করেছি. প্রতি পলে চেষ্টা করছি পূর্বজদের কৃতকর্মের দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিজেদের যোগ্য করে তোলার. প্রায় ২০ বছর গ্রামে থাকার সুবাদে বলতে পারি বাঙলার গ্রামগুলিতে নজর ফেলে দেখলে অনুভব করা যাবে, আড়াইশ বছরের ক্ষতচিহ্ন. সেখান থেকে চুঁইছে অপমানবোধের ঘাম, রক্ত, বেদনা. আঘাতে আঘাতে গ্রামীণ শিল্পীসমাজ আজ মূহ্যমান.
তাঁদের আবার পুরোনো পথে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন গ্রামীণদের ভাষ্য, দর্শণের নথিকরণ. 
শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি আর সংস্কৃতিতে বাঙলা দুশ বছর আগেও উত্তমর্ণ ছিল. স্বাধীণ বাঙলায় নেই নেই দশা. গ্রামশিল্পীদের নতুন প্রজন্মে ভাঁটার টান. শুধু আর্থিক দৈন্য নয়. গরীবিয়ানার প্রচারতো ছিলই. সঙ্গে শিরদাঁড়া বেঁকানোর প্রকল্পের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে ১৭৫৭র পরে. মার্ক্সবাদীদের অবদান খুব কম নয়. মার্ক্স-এঙ্গেলসএর নিদানে তাঁরা বিশ্বাস করেন শিল্পোন্নত ইওরোপই বাঙলার ত্রাতা. তাই দেশি প্রযুক্তিকে আদিমতম, লৌকিক ইত্যাদি ধারণায় দেগে দেওয়া হল. দেশি প্রযুক্তি রাষ্ট্রের বাইরে উপড়ে পড়ল. বাঙলার বিকশিত পারম্পরিক প্রযুক্তির বলিদান সম্পন্ন হল ১৯৪৭এর পর. শুধু বেঁচেরইল সহানুভূতির রাজনীতি.
চাই গ্রামীণ দৃষ্টিতে নথিকরণ
বাঙলার গ্রামের জ্ঞাণবিজ্ঞাণ চর্চা নথিকরণ প্রয়োজন গ্রামীণদের অহং জাগিয়ে তুলতে. আজকের গ্রামীণদের অনেকরই অতীত স্মৃতি ঝাপসা. তাঁদের পূর্বপুরুষ বিশ্বে তৈরি করেছিলেন নতুন দার্শণিক পথ, নতুন বাজার. এই নিভেযাওয়া আলো জ্বালাতে চাই কয়েক হাজার বছরের জীবনধারা, দর্শণ এবং প্রযুক্তির নথিকরণ প্রচার. শিল্পবিপ্লবে উদ্ধত পশ্চিম নিজেদের বোনা জালে জড়িয়ে বিশ্বকে ধ্বংস করছে. পশ্চিমি প্রযুক্তি লাভের কড়ি সিন্দুকেকে ভরা, মানুষকে উচ্ছেদ, মানুষের মন দখল আর প্রকৃতি লুঠে ব্যবহার হয়েছে. এই প্রযুক্তিতে মানুষ উদ্বৃত্ত. একে নিয়ে শিল্পবিপ্লবোত্তর পশ্চিম এগোতে পারছে না. নড়বড়ে অর্থনীতি, নতুন প্রযুক্তির দিশাহীনতা থেকেই পরিস্কার. বিশ্বকে হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষা করা গ্রামীণ প্রযুক্তির প্রয়োগের সময় আসছে. অন্য পথ নেই. তখন প্রয়োজন হবে এই নথিকরণের তথ্যগুলি.
এই দল গ্রামে গ্রামে জ্ঞাণ নথিকরণের কাজ করেছে দু দশক ধরে. দেখেছে গ্রামে অত্যাচারের আঘাতগুলো দেখা যাচ্ছে. বহু ব্যক্তি, সংঘ নানান নথি করে চলেছেন. সেই সাড়ার মধ্যেই কলাবতী মুদ্রার দল খুঁজতে চেয়েছে গ্রামীণ পথ. নানান পথবন্ধুর লেখা, সাহিত্য, বর্ণনা, নথিকরণের কাজে দেখতে চাইছে বাস্তব অবস্থা. পূর্বপথিকদের একটি হাতেগোণা অংশ গ্রামীণদের অনুভব নানানভাবে তুলে ধরেছেন. দলটি, নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করল ভারত আর বাঙলার সমাজকে. বলা দরকার পূর্বজদের বহু কাজে ছড়িয়ে রয়েছে ঔপনিবেশিক দর্শণের রেশ. তাঁদের অনেকে আজও প্রণম্য. আজও প্রশ্ন ওঠেনি তাঁদের দর্শণের. নতুন প্রশ্ন তুলে গ্রামসমাজের দর্শণের শিক্ষায়, গ্রামীণদের হাত ধরে শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্তের পিঠচাপড়ানি দর্শণএর বাইরে বেরিয়ে আসাও জরুরি. মাথা নিচু করে শিক্ষার্থীর প্রশ্নমুখ চোখে নিজেদের নিবেদন করার কাজ শুরু করল এই দল. অনেকেই এই দর্শণকে মধুর-দাস্যভাবরূপে কটাক্ষ করেছেন. তাঁদের কটাক্ষে এই দল কৃতার্থ. হয়ত সঠিক পথে চলতে পারছে তারা.
গ্রামশিল্পীরা আজ বাঙলার সংস্কৃতি জগতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন. মূল মঞ্চ দখল করে রেখেছেন শহরে বাস করা ক্ষমতার নানান অঙ্ক সমাধান করা শহুরেরা. এঁরাই বিশ্ববাসীকে ফোকের মায়াজালে ডুবিয়ে রেখেছেন. আর মাঝে মধ্যে কলকাতার প্রসেনিয়াম নাট্যচর্চায় উদ্বাস্তরমত চলে আসে লৌকিক নাট্যচর্চা.
যখনই প্রসেনিয়ামের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখনই মনেপড়ে দেশি নাট্যচর্চাকে. পার পেয়েগেলে সেই ত্রাতা ইওরোপ. যে নাট্যচর্চা জগত লেবেদফের নাটক করার প্রচেষ্টাকে বাঙলা নাট্যজগতের শুরু বলে ভাবেন, অন্ততঃ তাঁদের কাছে বাঙলার গ্রামীণ সংস্কৃতি জগতের কিছু পাওয়ার নেই এ কথা বুকঠুকে বলে দিচ্ছে কলাবতী মুদ্রা.
ঠিক এই বাস্তব অবস্থায় দাঁড়িয়ে কলাবতী মুদ্রা দুটি গ্রামশিল্পীদের সংগঠণকে প্রত্যক্ষ্যভাবে সাহায্য করতে বদ্ধ পরিকর. বাঙলার প্রণম্য গ্রামীণ শিল্পীরা তৈরি করতে যাচ্ছেন বাঙলার প্রথম গ্রামশিল্পীদের দ্বারা পরিচালিত দুটি সংগঠণ. যে শিল্পীরা ক্রাফ্টমার্কেরমত প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদ হওয়ার আশংকায় ভুগছেন, যারা আজ বাঙলার সংস্কৃতি জগতে ব্রাত্য, তাদের আজ একজোট হওয়ার সময় এসেছে.
একজোট না হলে যে শক্তিগুলো সংস্কৃতি অঙ্গণে ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে, তারা এতদিন একা ছিল. আজ খোলা বাজার নীতিতে তাদের সঙ্গে জুটেছে কর্পোরেট বড় ব্যবসায়ীরা. তাই নবতম উদ্যমে গ্রামশিল্পীদের ভালকরার নামে আদতে উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছে কর্পোরেট এনজিওরা.

কলাবতী মুদ্রার বারমাস্যা ২০১১-২০১২, Annual Report of Kalaboti Mudra 2011-2012


গ্রামের হাট প্লাসটিকে বেহাত
পারম্পরিক শিল্পীদের স্থান কমছে. গ্রামীণদের জীবনযাত্রা পাল্টেছে. শহরে নতুন বাজার. বিক্রি খারাপ নয়. নতুন প্রজন্মের সাড়া ভালই. এই বাজার গ্রামীণ শিল্পীদের অচেনা. ঠকবার ভয়ও আছে. জনগণের পয়সায় আয়োজিত শহুরে মেলাগুলো চলেযাচ্ছে ধণী কর্পোরেটিয় ফড়েদের কবলে. আইনি পথে খুচরো ব্যবসায় অবাধ বিদেশি পুঁজি ঢুকছে বাজারে. পরম্পরার পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে. পথব্যবসায়ী আর গ্রামশিল্পীদের জোটেই ভারত-চিন-পারস্য বিশ্ব শিল্পের ৮০ শতাংশের অংশিদার ছিল. এই অক্ষের বড় অংশিদার ছিল বাঙলা. তাই দেশে জ্ঞাণ বিজ্ঞাণ চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিল. ১৮৩৬এও বাঙলা-বিহারের একলাখ গ্রামে ছিল দেড় লাখ পাঠশালা. সেই কেন্দ্রবিহীন গ্রামভিত্তিক পাঠশলা পরিচালন করছে গ্রামগোষ্ঠী.
পলাশীর পর দেশী পড়াশুনো ধংস হয়েছে
ইওরোপিয় নতুন ধরণের হিসাবরাখার পড়াশুনোর তুমুল প্রচারে শহুরে ভারত ভুলেগিয়েছে, পথ ব্যবসায়ীরা অকেন্দ্রিয়ভাবে শয়ে শয়ে বছর ধরে ভারতজুড়ে বিশদে পণ্যের হিসেব রাখা, বীমা ব্যবস্থা, দ্রব্য বিতরণ ব্যবস্থা, দীর্ঘদিনধরে দ্রব্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, পুঁজি বিনিয়োগের বিকেন্দ্রিয় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন. শুধু জটিল বললে ভুল হবে, ব্যাপ্তি আজও অকল্পনীয়ও. ইওরোপের ডবল এন্ট্রি হিসেব আবিষ্কারের বহু আগেই ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই পদ্ধতিতে কাজ করতেন.
অহিংসপথে জ্ঞাণবিপড়াশুনোর পথিকৃত ভারত, অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বিশ্বকে অবাধে জ্ঞাণ বিতরণ করেছে, পেটেন্ট করাকে ঘৃণা করেছে, বিশ্বজোড়া একচেটিয়া আফিম, নীল, নুন আর সোরা উত্পাদন হত বাঙলায় তবুও বিশ্বধংসী শিল্পবিপ্লব ঘটায় নি, কৃষকমারা নীলকরও হতে চায় নি.
এখনও ৯৯শতাংশ গ্রামশিল্পী বিদ্যুত ব্যবহার করেন না, আজও ডোকরা কামারদের ধাতুর কাজে জং পড়ে না, একবিংশ শতকেও হাতের তাঁতের গুণমানের আশেপাশে আসতে পারে না কলের কাপড়, ভারতের পারম্পরিক সেচ ব্যবস্থা আজও বিষ্ময়, এখনও ভারতীয় স্থাপত্যবিদ্যার মূলে পৌঁছতে পারে নি পশ্চিম, ইওরোপ টিকা আবিষ্কারের আগে টিকাদান আর শল্যচিকিত্সা সাধারণ কাজ ছিল, বিহার-বাঙলার দেড় লক্ষ গ্রামে এক লক্ষ প্রাথমিক পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন চন্ডাল, মুচি, দোসাধ, মুসলমান-খ্রিস্টান শিক্ষক, গ্রামীণদেরই অর্থে আর পরিকাঠামো ব্যবহার করে, এলাহাবাদেরমত গরম অক্ষাংশে বরফ তৈরি হত. ভারতের চিকিত্সা ব্যবস্থা ভিত্তি করে বেড়ে উঠেছে বিষচিকিত্সার এলোপ্যাথি ব্যবস্থা, দস্তা পরিস্রবণে আজও পারম্পরিক ভারতীয় প্রযুক্তি অনন্য, হাল্কা জাহাজ(ক্লিপার) তৈরির প্রযুক্তি ইংরেজরা নিয়েছিল বাঙলা আর বম্বে থেকে, বাঙলার গ্রামসমাজের নানান ধরণের হালের নথি করে ইংলন্ডে কৃষি বিকাশ হয়েছে, পশ্চিমকে গ্রীষ্মের উপযোগী সুতির কাপড় পরিয়েছে, খোলামেলা বাংলা(বাংলো আর কারি শব্দটি বাঙালা থেকে চুরি করা) স্থাপত্যের বাড়ি তৈরি করতে শিখিয়েছে, মশলা খেতে শিখিয়েছে. সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতায় ড্রাই ডক, কলণবিদ্যায় কেরলের অবদান, শূণ্য, দশমিক, পাইএর মান, পৃথিবীর ব্যাসের মান তৈরিতে ভারতের অবদান বহু আলোচিত. হরপ্রসাদ আর রাখালদাস প্রমাণ করেছেন বাঁকুড়ার পোখন্নার গ্রামের কামারদের তৈরি অজর অমর লৌহস্তম্ভ আজও দিল্লিতে মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে.
এরকম বহু জ্ঞাণ চুরি করে ইওরোপ অধর্মণ থেকে উত্তমর্ণ মহাদেশে পরিণত হয়েছে. আজও এই জ্ঞাণকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে. অথচ পশ্চিমি প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে নিয়ন্ত্রণ আর শ্রম প্রতিস্থাপনের জন্য. এশিয় প্রযুক্তি তার উল্টোপথে হেঁটে বিশ্বকে শিখিয়েছে একসঙ্গে বেঁচে থাকার জীবনযাত্রা. সেই ইতিহাস ভুলেছেন বহু গ্রামশিল্পী. ভুলেছেন বাঙলা বিকাশে তাঁদের পুর্বজদের অবদান. সরকারি, বেসরকারি সংস্থার অর্থে অনেকেই আজ বিদেশি নকলে ব্যস্ত. অনেকেই তাঁদের বংশপরম্পরার কলাবিদ্যা ছাড়ছেন.
দেশি পড়াশুনোর অংশিদার ছিলেন গ্রামশিল্পীরা
বাঙলার গ্রামীণ শিল্পীরা ভুলে গিয়েছেন তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারত সভ্যতার স্রষ্টা. এঁরা অজন্তা ইলোরা, বরবুদর, দিল্লির লোহার মিনার, মসলিন কাপড় তৈরি করতেন. এরাই ছিলেন বিশ্বযশা শিল্পী, প্রযুক্তিবিদ. এঁদের পণ্য, অভিনয়-বাদ্য কলা রপ্তানি হত বিশ্ব বাজারে. এঁদের কর্মকুশলতায় ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাঙলার অর্থনীতি ছিল উদ্বৃত্ত. সারা বিশ্বের বণিকেরা বাঙলাতে আসতেন বাণিজ্য করতে. বাঙলার শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করারমত বিশ্বে খুব কম শিল্পী ছিলেন.
বালুচরী, মসলিন, রেশম, তুলো, এন্ডি, মোম, মধু বাঁশ, কাঠ, শিতলপাটি, গৌড়িগুড়মদ, পাথরশিল্প, শাঁখশিল্প, আখ, চিনি, নুন, সুপুরি, নীল, চাল, লাক্ষা, আফিম, সোরা, পান, খয়ের, হাতি, হাতিরদাঁতশিল্প, শোলা, নৌপোত, চিত্রকলা, শিল্পকলাসহ বহু দ্রব্যের চাহিদা ছিল অসীম. এই সব পণ্য তৈরি আর চাষ করতেন এই শিল্পীরাই. ১৮০০ সাল পর্যন্ত ইওরোপ, বাঙলা তথা ভারতের জীবনযাত্রা নকল করত. বাঙলাই বিশ্বকে পথ দেখিযেছে. বাঙলা প্রযুক্তিও রপ্তানি করেছে. প্রযুক্তি ছিল এই শিল্পীদের পূর্বজদের দখলে. এই দেশি পড়াশুনোর অংশিদার ছিলেন গ্রামশিল্পীরা. পলাশির পর পড়াশুনো পরিবেশ ধংসই হয় নি, তাঁদের রুটিরুজিতে হাত দিয়েছে রাষ্ট্র.